বাংলাদেশে বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া

May 23, 2024 - 23:53
 0  118
বাংলাদেশে বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া
বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত আইন

বাংলাদেশে বিবাহ ও তালাকের প্রক্রিয়া, শর্ত, নোটিশ, পুনর্মিলন প্রচেষ্টা ও পারিবারিক আদালতের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন।

বিবাহ

বিবাহ হলো দুটি ব্যক্তির মধ্যে একটি আইনি এবং সামাজিকভাবে স্বীকৃত সম্পর্ক, যা পারস্পরিক সম্মতি, নির্ধারিত বয়স, কাবিননামা, এবং দুই সাক্ষীর উপস্থিতিতে নিবন্ধিত হয়। বাংলাদেশে মুসলিম বিবাহ নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী, বিবাহের জন্য বরের ন্যূনতম বয়স ২১ বছর এবং কনের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর হতে হবে। বিবাহ সম্পন্ন হলে, এটি নিকার রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে নিবন্ধন করা হয়, যা আইনগত সুরক্ষা প্রদান করে।

তালাক

তালাক হলো স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কের আইনগত বিচ্ছেদ, যা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও শর্ত পূরণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ অনুসারে, তালাক দেওয়ার আগে স্বামীকে একটি লিখিত নোটিশ চেয়ারম্যানকে প্রদান করতে হবে এবং স্ত্রীর কাছে একটি কপি পাঠাতে হবে। নোটিশের পর ৯০ দিনের মধ্যে পুনর্মিলনের চেষ্টা করতে হবে, পুনর্মিলন না হলে তালাক কার্যকর হবে।

বিবাহের পূর্ব শর্তগুলি

মুসলিম বিবাহের জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলি পূরণ করতে হবে:

বর ও কনের সম্মতি: বর এবং কনে উভয়ের সম্মতি বিবাহের জন্য বাধ্যতামূলক।

  1. বর এবং কনের বয়স: বর এবং কনের বয়স আইনত নির্ধারিত হওয়া উচিত। মুসলিম বিবাহ নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী, বরের সর্বনিম্ন বয়স ২১ বছর এবং কনের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর হতে হবে।
  2. কাবিননামা: বিবাহের সময় কাবিননামা প্রস্তুত করা আবশ্যক। এতে কাবিনের পরিমাণ উল্লেখ থাকবে যা বর কর্তৃক কনেকে প্রদান করা হয়।
  3. দুই সাক্ষীর উপস্থিতি: কমপক্ষে দুইজন মুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিবাহ সম্পন্ন হতে হবে।
  4. নিকার রেজিস্ট্রার: নিবন্ধিত নিকার রেজিস্ট্রার দ্বারা বিবাহ নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক।

বাংলাদেশের বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত আইনগুলি মূলত দুটি প্রধান আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়: মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ (Muslim Family Laws Ordinance, 1961) এবং পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ (Family Courts Ordinance, 1985)। এখানে আমি বিস্তারিতভাবে এই আইনগুলি ব্যাখ্যা করবো।

মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১

এই অধ্যাদেশটি মুসলিম বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে। এর কয়েকটি প্রধান ধারা হলো:

ধারা ৬: দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি

  • কোনো ব্যক্তি যদি জীবিত স্ত্রীর জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিবাহ করতে চান, তাহলে তাকে প্রথমে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।
  • অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ করলে এক বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে।

তালাকের আইনি প্রক্রিয়া

ধারা ৭: তালাকের নোটিশ প্রদান

  1. তালাক ঘোষণা:

    • স্বামী যখন তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তখন তাকে তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা মুখে বা লিখিতভাবে ঘোষণা করতে হবে।
  2. লিখিত নোটিশ:

    • তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, স্বামীকে লিখিত নোটিশ চেয়ারম্যান (স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভার মেয়র) বরাবর প্রেরণ করতে হবে। এই নোটিশে তালাকের কারণ উল্লেখ করতে হবে।
    • একই নোটিশ স্ত্রীর কাছেও পাঠাতে হবে।
  3. চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ গ্রহণ:

    • চেয়ারম্যান নোটিশ প্রাপ্তির পর তা রেজিস্টারে নথিভুক্ত করবেন এবং স্বামীর জন্য একটি প্রাপ্তি স্বীকার পত্র (acknowledgment receipt) ইস্যু করবেন।

পুনর্মিলনের প্রচেষ্টা

  1. আরবিট্রেশন কাউন্সিল গঠন:

    • নোটিশ প্রাপ্তির পর চেয়ারম্যান পুনর্মিলনের জন্য একটি আরবিট্রেশন কাউন্সিল গঠন করবেন। এই কাউন্সিলের সদস্যরা স্বামী, স্ত্রী এবং তাদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে।
    • কাউন্সিল উভয় পক্ষকে পুনর্মিলনের জন্য চেষ্টা করবে।
  2. পুনর্মিলনের সময়কাল:

    • নোটিশ দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে পুনর্মিলন সম্ভব না হলে তালাক কার্যকর হবে।

তালাক কার্যকর হওয়া

  1. তালাক কার্যকর হওয়া:

  • নোটিশ দেওয়ার ৯০ দিন পর, যদি পুনর্মিলন না হয়, তাহলে তালাক কার্যকর হবে।
  • যদি স্ত্রী গর্ভবতী হন, তবে সন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।

আইনি নথি:

    1. তালাক কার্যকর হওয়ার পর, চেয়ারম্যান একটি তালাক সার্টিফিকেট ইস্যু করবেন যা আইনি প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।

পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫

এই অধ্যাদেশটি পারিবারিক মামলাগুলি সমাধানের জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করেছে। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো:

ধারা ৫: আদালতের এখতিয়ার

  • পারিবারিক আদালত নিম্নলিখিত মামলাগুলি বিচার করতে পারবে: বিবাহ, তালাক, দাম্পত্য অধিকার, খোরপোষ, শিশুদের হেফাজত, এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা।

ধারা ৭: সালিশি প্রক্রিয়া

  • আদালত উভয় পক্ষকে সালিশির মাধ্যমে সমাধান করতে উৎসাহিত করবে।
  • সালিশি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে, আদালত মামলা পরিচালনা করবে এবং রায় প্রদান করবে।

শাস্তির বিধান

  • অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ: এক বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়দণ্ড (মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১, ধারা ৬)।
  • তালাকের নোটিশ না দিলে: ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ড হতে পারে।

বিবাহ নিবন্ধন

  • মুসলিম বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক এবং নিবন্ধক (নিকার) দ্বারা সম্পন্ন করতে হবে।
  • নিবন্ধিত বিবাহ আইনি সুরক্ষা প্রদান করে এবং বিতর্কের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয়।

আদালতের প্রক্রিয়া

  • বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত মামলাগুলি পারিবারিক আদালতে দায়ের করতে হয়।
  • পারিবারিক আদালত দ্রুত ও কার্যকর বিচার প্রদান করতে পারে।

পারিবারিক আদালতে নিম্ন বর্ণিত মামলাগুলি দায়ের করা যায়।

বাংলাদেশের পারিবারিক আদালত পারিবারিক বিরোধের দ্রুত ও কার্যকর সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫-এর অধীনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি এই আদালতে মামলা হিসেবে দায়ের করা যায়:

১. বিবাহবিচ্ছেদ (Divorce)

বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়, যেমন তালাক প্রদান, তালাকের পরে অধিকার ও দায়িত্ব, এবং পুনর্মিলনের চেষ্টার মামলা পারিবারিক আদালতে করা হয়।

২. দাম্পত্য অধিকার (Restitution of Conjugal Rights)

যদি কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মামলা দায়ের করতে চায়, তবে তা পারিবারিক আদালতে করতে হবে। এটি সাধারণত তখন হয় যখন এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ছেড়ে চলে যায় বা সঙ্গ দিতে অস্বীকার করে।

৩. খোরপোষ (Maintenance)

বিবাহিত জীবনযাপনের সময় বা বিবাহবিচ্ছেদের পরে স্ত্রীর খোরপোষ ও সন্তানের খোরপোষ সংক্রান্ত মামলা পারিবারিক আদালতে করা হয়। স্ত্রীর অধিকার অনুযায়ী, স্বামীর প্রতি তার খোরপোষের দাবি দায়ের করা যায়।

৪. শিশুদের হেফাজত ও অভিভাবকত্ব (Custody and Guardianship of Children)

শিশুদের হেফাজত, অভিভাবকত্ব, এবং তাদের ভরণপোষণের জন্য মামলা করা যায়। কোন পিতামাতা বা অভিভাবক সন্তানের হেফাজত পাওয়ার অধিকারী তা নির্ধারণ করতে পারিবারিক আদালত মামলা গ্রহণ করে।

৫. সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ (Property Disputes)

পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ, বিশেষ করে বিবাহবিচ্ছেদের পরে সম্পত্তির বন্টন ও অধিকার সংক্রান্ত মামলা পারিবারিক আদালতে করা যায়।

৬. স্ত্রী এবং সন্তানের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা (Protection Orders)

পারিবারিক আদালত স্ত্রীর প্রতি নির্যাতন বা সন্তানের প্রতি নির্যাতনের ক্ষেত্রে সুরক্ষা আদেশ দিতে পারে। স্ত্রী বা সন্তান নির্যাতনের শিকার হলে তারা পারিবারিক আদালতে সুরক্ষা চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারে।



What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow